ঢাকা, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪ | অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১
ঢাকা, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪       
Shruhid Tea

এমপি আনার হত্যা

যেভাবে পরিকল্পনা ও কেন কলকাতায় হত্যা, জানালো ডিবি

নিজস্ব প্রতিবেদক বঙ্গবাণী

প্রকাশিত: ১৮:৪২, ২৩ মে ২০২৪

যেভাবে পরিকল্পনা ও কেন কলকাতায় হত্যা, জানালো ডিবি

সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন ডিএমপির গোয়েন্দা প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেছেন, দুই থেকে তিন মাস ধরে এমপি আনোয়ারুল আজীম আনারকে হত্যার পরিকল্পনা করে তার বাল্যবন্ধু আক্তারুজ্জামান শাহীন! দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার কারণে তারা হত্যার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ভারতে কলকাতাকে বেছে নেয়। বৃহস্পতিবার (২৩ মে) দুপুরে মিন্টু রোডে ডিবি কার্যলয়ে তিনি এসব তথ্য জানান।

হারুন বলেন, ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা দীর্ঘদিনের। আনারকে হত্যার পরিকল্পনা করেন তার বাল্যবন্ধু ও ব্যবসায়ীক পাটনার আক্তারুজ্জামান শাহীন। শাহীনের পরিকল্পনায় হত্যার কাজটি করেন পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির নেতা আমানউল্লাহ আমান ওরফে শিমুল।

কলকাতায় গত ১৩ মে বাংলাদেশের সংসদ সদস্য আনারকে অত্যন্ত নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, লাশ গুম করার জন্য পৈচাশিকভাবে মরদেহ টুকরো টুকরো করে বিভিন্ন স্থানে ফেলে দেওয়া হয়েছে। ঘটনায় জড়িত মূলহত্যাকারীসহ গ্রেফতার তিন জনকে জিজ্ঞাসাবাদে আমাদের এসব তথ্য জানায়।

জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে হারুন আরও বলেন, ঢাকার গুলশান ও বসুন্ধরায় বসে একাধিকবার আলোচনা করেছে হত্যাকারীরা। আনারকে হত্যা করতে প্রথমে তারা বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করতে চেয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে ডিএমপির ডিবির তদন্ত সক্ষমতার কথা চিন্তা করে তারা দেশের বাইরের মাটিতে পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে গত মাসের ২৫ তারিখ কলকাতায় তারা বাসা ভাড়া করে। নিহত সংসদ সদস্যের বন্ধু আক্তারুজ্জামান শাহীন, তার বান্ধবী এবং পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির নেতা আমান উল্লাহ আমান ওরফে শিমুল গত ৩০ এপ্রিল ঢাকা থেকে বিমানে করে কলাকাতায় গিয়ে সেই বাসায় ওঠে। মূলত পরিবার নিয়ে থাকার তথ্য দিয়ে বাড়ির মালিকের সঙ্গে চুক্তি করে।

হারুন আরও বলেন, হত্যাকারীরা দুই মাস ধরে সংসদ সদস্যকে নজরদারিতে রাখছিল। কখন তিনি কলকাতায় যায় তার খবর রাখছিল। সংসদ সদস্য বিভিন্ন সময়ে কলকাতায় যেতেন। সেখানে তিনি দীর্ঘদিন বাস করেছেন। সেখানে তার বন্ধু-বান্ধব রয়েছে। তারা এই সুযোগটি কাজে লাগিয়েছে।

তিনি বলেন, এমপি আনার কলকাতায় গিয়ে তার বন্ধু গোপালের বাসায় গিয়ে ওঠেন। তারা জানতো ১২ মে সংসদ সদস্য কলকাতায় যাবেন। হত্যার পরিকল্পনাকারীরা ৩০ এপ্রিল কলকাতায় গিয়ে স্থানীয় দুজনকে ঠিক করে। তারা হলো– জিহাদ ওরফে জাহিদ ও সিয়াম। হত্যার পরিকল্পনাকারী শাহীন হত্যার পর কোন গাড়ি ব্যবহার করা হবে, কাকে কত টাকা দিতে হবে– সেগুলো ঠিক করে ১০ মে বাংলাদেশে  ফিরে আসেন। নিহত সংসদ সদস্য কলকাতায় যাওয়ার পর ১৩ তারিখ ওই বাসায় যান। যাওয়ার পথে একটি সাদা গাড়িতে করে ফয়সাল নামের এক ব্যক্তি তাকে নিয়ে যায়। গাড়িটি কিছু পথ যাওয়ার পরে হত্যাকারী আমান উল্লাহ সেই গাড়িতে ওঠে। গাড়িটির চালক ছিল রাজা।

সেই বাসায় (নিউ টাউন এলাকার সঞ্জিভা গার্ডেন) যাওয়ার পর মোস্তাফিজসহ তারা বাসায় প্রবেশ করে। বাসাটিতে আগে থেকে জাহিদ ও সিয়াম অবস্থান করছিল। ১৩ তারিখ দুপুরে ২টা ৫১ মিনিটে বাসায় প্রবেশ করেন আনার। এর ৩০ মিনিটের মধ্যেই হত্যা করা হয় তাকে।

হত্যার পরে ঘাতকরা সংসদ সদস্যের মোবাইল ফোন দিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তিকে ম্যাসেজ পাঠায়। এরপর তারা মরদেহের হাড় থেকে মাংস আলাদা করে। পরবর্তীতে দুটি ব্রিফকেসে করে জিহাদ ও সিয়াম মরদেহ গাড়িতে করে ফেলে দেয় যাতে আনারের চিহ্ন না থাকে। কাজ শেষ করে ১৫ তারিখ আমানউল্লাহ আমান ও শাহীনের প্রেমিকা শিরিস্তি দেশে ফিরে আসে। সবাই ফিরে আসায় হত্যার মাস্টারমাইন্ড শাহীন বিমানে করে দিল্লি, সেখানে ২ ঘণ্টার ট্রানজিট নিয়ে কাঠমান্ডু যায়। সেখান থেকে অন্য কোনও দেশে চলে যান।

হারুন আরও বলেন, হত্যার বিষয়টি প্রকাশ হওয়ার পরে দেখা গেছে, হত্যাকারীরা তদন্তকারীদের বিভ্রান্ত করতে নিহত সংসদ সদস্যের দুটি মোবাইল ফোন দুই দিকে নিয়ে যায়। এরপর তারা বিভিন্ন জনকে বার্তা পাঠায় ও কল করতে থাকে। এটা করে যাতে তদন্তকারীরা বুঝতে পারে তিনি জীবিত আছেন। এমনকি গত ১৮ তারিখ এমপির ব্যক্তিগত সহকারীকে একটি ম্যাসেজ পাঠায় যাতে বলা হয়– ‘আমি দিল্লি যাচ্ছি। আমার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আছেন। দিল্লির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সঙ্গে আমার একটি মিটিং আছে’। এই বার্তাগুলো আমরা যখন পেয়েছি তখনই বুঝতে পেরেছি হত্যাকারীরা নিজেদের আড়াল করতে এই বার্তা পাঠিয়েছে। হত্যাকারীরা দুটি মোবাইল কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চল ও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় পাঠায়। সব কিছু মিলিয়ে তারা এই হত্যাটি করেছে, জানান হারুন।

উল্লেখ্য, আনোয়ারুল আজিম আনার ঝিনাইদহ-৪ (সদর ও কালীগঞ্জ) আসনের সরকারদলীয় সংসদ সদস্য। তিনি ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে টানা তিন বার আওয়ামী লীগ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন তিনি। 

গত ১২ মে তিনি চিকিৎসার কথা বলে ভারতে যান। কিন্তু ১৪ মে থেকে পরিবার ও দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে তার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় ছিল। তার ব্যবহৃত হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরটিও বন্ধ ছিল। পরে পরিবারের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যোগাযোগ করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে থেকে দিল্লিতে বাংলাদেশ দূতাবাস ও কলকাতায় উপদূতাবাসে যোগাযোগ করে খোঁজ নিতে বলা হয়।

এদিকে চিকিৎসার জন্য ১২ মে দুপুরের দিকে দর্শনা-গেদে সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন আনোয়ারুল আজিম। ওইদিন সন্ধ্যায় কলকাতার অদূরে ব্যারাকপুর কমিশনারেট এলাকার বরাহনগর থানার মণ্ডলপাড়া লেনের স্বর্ণ ব্যবসায়ী ও দীর্ঘদিনের বন্ধু গোপাল বিশ্বাসের বাড়িতে পৌঁছান তিনি। পরদিন ‘বিশেষ প্রয়োজনের’ কথা বলে গোপালের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান আনোয়ারুল আজিম। পরে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে কলকাতার বরাহনগর থানায় ১৮ মে লিখিত ‘মিসিং ডায়েরি’ করেন গোপাল বিশ্বাস।

বুধবার (২২ মে) সকালে গোপাল বিশ্বাস স্থানীয় গণমাধ্যমকে জানান, এমপি আজিমকে হত্যা করা হয়েছে বলে কলকাতা পুলিশ তাকে জানিয়েছে। কলকাতার নিউ টাউনের বিলাসবহুল আবাসন ‘সঞ্জিভা গার্ডেনে’ এই এমপি হত্যার শিকার হন।

বঙ্গবাণীডটকম/এমএস

জাতীয় বিভাগের সর্বাধিক পঠিত